বয়ঃসন্ধি সংক্রান্ত পাঠদান এড়িয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকরা

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৬-১০-১৯ ৪:৩৮:৩৮ পিএম
বয়ঃসন্ধি সংক্রান্ত পাঠদান এড়িয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকরা
ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

নারায়ণগঞ্জ থেকে ফিরে: কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো সর্ম্পকে ক্লাসে পাঠদান এড়িয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকেরা। এইডস, প্রজনন স্বাস্থ্য বা বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো বাসায় পড়ে নেওয়ার জন্যেই শিক্ষার্থীদের নির্দেশ দিচ্ছেন তারা।

 

নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজের শিক্ষার্থী শাহনাজ আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, বয়ঃসন্ধির বিষয়গুলো স্কুলে পাঠদান করা হয় না। পাঠ্যবইয়ে যে খানে এইডসের বিষয়ে সচেতনতার কথা বলা হয়েছে, সেই স্থানটুকু এড়িয়ে যান শিক্ষকরা। বলেন বাসায় পড়ে নিতে।

হার্ভার্ড স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ সোহাগ বলেন, আমরা নিজেদের শারীরিক পরিবর্তনগুলো বন্ধুদের সঙ্গেই শেয়ার করি। এছাড়া স্কুলের শিক্ষক বা অভিভাবকদের সঙ্গে এ নিয়ে কখনোই আলোচনা হয় না। বইয়ের বাইরেও কিছু বিষয় থাকে যেগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যেই আলোচনা করি। অনেকেই ভুল করে বসে, সন্দেহ ও কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে নিজের খারাপ করে ফেলে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. প্রবীর কুমার বাংলানিউজকে বলেন, কিশোরীদের বিষয়গুলোর সর্ম্পকে কিছু জানা থাকলেও, কিশোরদের বয়ঃসন্ধির পরিবর্তনগুলো নিয়ে আমরা একেবারেই আলোচনা করি না। এ কারণে কিশোরদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি নিজের চেম্বারে এক কিশোর রোগীর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, কৌত‍ূহলের বশবর্তী হয়ে ওই কিশোরের শিশ্নাঙ্গ দিয়ে কলমের নিব প্রবেশ করায় তার এক বন্ধু। তাদের মনে হয়েছিলো, মেয়েদের প্রস্রাবের পথের মতোই তার শিশ্নাঙ্গও কাজ করবে।

শারীরিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো শিক্ষার্থী ও সন্তানদের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা না করায় এ ধরনের ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটছে বলেও মনে করেন ওই চিকিৎসক।

নারায়ণগঞ্জের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা বলেন, স্কুলে ছাত্রীদের সমস্যাগুলো তারা সবসময় সবার কাছে বলতে পারেন না। বেশিরভাগ সময় শিক্ষিকাকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না ছাত্রীরা। কারণ শিক্ষক-শিক্ষিকারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বয়ঃসন্ধির এই বিষয়গুলো নিয়ে খোলা-মেলা আলোচনা করেন না। সামাজিক স্টিগমা কাজ করে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অ্যাডোলসেন্ট অ্যান্ড স্কুল হেলথ প্রোগ্রামের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার শফিউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, শিক্ষার্থীদের এ ধরনের সমস্যা দূর করতে সরকারের স্কুল হেলথ ক্লিনিক প্রোগ্রাম চালু হয়েছে। ১৯৫১ সালে ঢাকা ও চট্রগ্রাম শহরে সর্বপ্রথম চালু হওয়া স্কুল হেলথ কার্যক্রম চলছে ২৩টি জেলায়।

এই বিদ্যালয়কেন্দ্রিক স্বাস্থ্য সেবার আওতায় স্কুল হেলথ ক্লিনিক রয়েছে যেখানে দুইজন মেডিকেল অফিসারের তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীদের টিকাদান, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন এবং ফার্স্ট এইডের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণ শক্তির স্ক্রিনিং সুবিধাসহ ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস সংক্রান্ত বিভিন্ন স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি রয়েছে স্কুল হেলথ ক্লিনিকের তত্ত্বাবধানে।

পাঠ্য পুস্তক প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য হিসেবে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে সপ্তম থেকে নবম শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে বিষয়গুলো ঘুরিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, স্বপ্নদোষের বিষয়ে বলা হয়েছে, রাতে ঘুমের মধ্যে ধাতু নির্গত হওয়া। সেখানে সরাসরি স্বপ্নদোষের কারণ ও লক্ষণগুলো বলতে হবে। সামাজিক এ দেয়ালগুলো ভাঙতে হবে।’

তিনি বলেন, পাঠ্যপুস্তকে বিষয়গুলো আরও বেশি অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়েছিলো। কিন্তু কমিটির পক্ষে সব সুপারিশ রাখা সম্ভব হয় না।

স্বাস্থ্য সংলাপের মাধ্যমে জনগণকে সম্পৃক্ত করে সরকারের বিদ্যালয় কেন্দ্রিক স্বাস্থ্য কর্মসূচি আরও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় আইসিডিডিআরবি-এর শেয়ার প্রকল্প কাজ করছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কার্যকর তথ্য-উপাত্ত ভিত্তিক স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপকদের নিয়ে ‘স্বাস্থ্য গবেষণা, স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে জনগণকে সম্পৃক্ত করা ও জেলা স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা সুসংহত করা’ সংক্রান্ত বিভিন্ন সক্ষমতা বৃদ্ধির কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে এই প্রকল্প।

এ বিষয়ে আইসিডিডিআরবি-এর বৈজ্ঞানিক এবং শেয়ার প্রকল্পের পরিচালক ড. ইকবাল আনোয়ার বলেন, এক সময় বিদ্যালয়ে হেলথ প্রোগ্রাম বলতে শুধু টিকা দেওয়াকে বোঝাতো। এখন তার বিস্তৃতি হয়েছে। কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালে সাপোর্ট দেওয়াও এখন এর অর্ন্তগত। বিদ্যালয়কেন্দ্রিক স্বাস্থ্যসেবা আরও ফলপ্রসূ করতে শিক্ষক ও অভিভাবকদের শিশু-কিশোর-কিশোরীদের সহজ যোগাযোগের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।

তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য শিক্ষার সঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতি অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। সন্তানদের সঙ্গে শিক্ষক এবং অভিভাবকদের দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে। দেশের সংস্কৃতির কথা বিবেচনা করে সংবেদনশীলতার সঙ্গে জনমুখী স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিতে হবে।